মিনার হাসান
‘কক্সবাজার’ শব্দটি কানে বাজলে মনের দৃশ্যপটে ফুটে উঠে সাগরের গর্জন,বালুচর ও সবুজ পাহাড়ের মিতালি। বিকেলের রক্তিম সুর্যের সমুদ্রস্নান। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। প্রতিদিন অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক কক্সবাজারে ভ্রমণে আসে। কক্সবাজার সৈকতে গেলে দেখা যায় অভাবনীয় দৃশ্য। হাজার হাজার নারী-পুরুষ শিশুর অপূর্ব মিলনমেলা। তাদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে মুখরিত সাগর তীর। ইনানিতে পাথরের সৈকত, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, হিমছড়ির ঝরনা, ডুলহাজারা সাফারিপার্কসহ কক্সবাজার জেলার পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় লেগেই থাকে বছর জুড়ে।সমুদ্রকন্যা কক্সবাজার বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সবচেয়ে বড়খাত।কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প বিস্তারের জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে কয়েকগুচ্ছ মেগা প্রকল্প। যার কয়েকটি প্রকল্প এখন দৃশ্যমান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে ‘মেরিন ড্রাইভ সড়ক’ প্রকল্প, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার কাজ, মহেশখালী টু্যরিজম পার্ক প্রকল্প, টেকনাফের সাবরাং এলাকায় ১২০০ একর জমিতে বিশেষ পর্যটন অঞ্চল প্রকল্প, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ, এবিসি সড়ক সম্প্রসারণ, কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাটে ব্রীজ প্রকল্প, দোহাজারী-ঘুমধুম-কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প, কক্সবাজারে পর্যটনের উন্নয়নে পর্যটন কর্পোরেশনের মালিকাধিন মোটেল শৈবালের ১২৫ একর জমিতে আর্ন্তজাতিক মানের পর্যটন জোন বাস্তবায়ন, একই সঙ্গে মোটেল প্রবালের ৬ একর জমিতে পর্যটন বিষয়ক একটি ইনষ্টিটিউট তৈরী করার পরিকল্পনা। উক্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে কক্সবাজার হবে একটি আদর্শ পর্যটন শহর এবং যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। শহরের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল নিধন, সরকারি খাসজমি দখল করে অবৈধ ইমারত গড়ে ওঠার কারণে পর্যটন শহর এখন শ্রীহীন। অপরিকল্পিত নগরায়ন থেকে রক্ষা করার জন্য ও পর্যটন শিল্পকে বিস্তারের জন্য গঠন করা হয়েছে” কক্সবাজার উন্নয়ন কতৃপক্ষ” । পর্যটকদের সার্বিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করারা জন্য বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছে টুরিস্ট পুলিশ। পর্যটনকে বিকশিত করার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন সময়মাত্র। কিন্তু সুষ্ঠু ও সময়মত প্রকল্পের বাস্তবায়ন করার দিকে নজর দিতে হবে সরকারের তাহলে দ্রুত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে এবং প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। যা বেকারত্ব হ্রাসে ভূমিকা রাখবে ।
পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাঃ
কক্সবাজার সহ সারাদেশের পর্যটন শিল্পে শুধু সমস্যা বেষ্টিত নয় । এখানে অবারিত সম্ভাবনাও রয়েছে ।পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মাস্টার প্ল্যান নিয়ে যদি কাজ করা যায় তাহলে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে উন্নত আয়ের দেশে পরিণত করা যাবে। এছাড়া এ শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এ ছাড়াও যে সম্ভাবনাগুলোকে পুঁজি করে আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি, সেগুলো হল-
১. পর্যটন করপোরেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সাল নাগাদ জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ১ হাজার ৯৯ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এটা হবে বৈদেশিক আয়ের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে পর্যটন খাতে কর্মসংস্থানের সংখ্যা বেড়ে ৩৭ লাখ ৯১ হাজারে উন্নীত হবে।
২. প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশে পর্যটকদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আবাসন সুবিধা, অবকাঠামো সংস্কার, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ২০২১ সালে বাংলাদেশের পর্যটন খাত দেশের অন্যতম সমৃদ্ধশালী শিল্পে পরিণত হবে । বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে গড়ে পাঁচ লাখ পর্যটক এসেছে বাংলাদেশে।
৩. বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে PPP(পিপিপি)এর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এছাড়া কক্সবাজারে একান্ত টুরিস্ট জোন প্রকল্প, ট্যুরিস্ট পুলিশ বাহিনী গঠন করেছে। এছাড়া নুতন নুতন প্রকল্পের মধ্যে অবহেলিত কিন্তু টুরিজম বান্ধব প্রকল্পের মাধ্যমে ট্যুরিজম স্পট সৃষ্টি করেছে যা পর্যটনের জন্য ইতিবাচক।
৪. ২০১১ সালে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১.৮ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। আশা করা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে মোট জনসংখ্যার ৪.২ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এই শিল্পের মাধ্যমে।
৫. বর্তমান সরকার ২০১২ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনকে ৬৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে পর্যটন করপোরেশনের প্রমোশন এবং বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার জন্য। বাংলাদেশ ২০১২ সালে শুধু পর্যটন শিল্প দিয়ে ১০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার রাজস্ব আয় করেছে। গত বছরও এ খাত থেকে রাজস্ব আয় বেশ সন্তোষজনক।
৬.World Tourist Organization তথা বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (WTO) পর্যটন শিল্পের জন্য অপরিহার্য যেসব উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে, যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যম-ন্ডিত স্থান, পাহাড়-নদী-অরণ্য, সমুদ্র সৈকত, মানুষের বিচিত্র জীবন ধারা, বন্য প্রাণী, নানা উৎসব ইত্যাদি তার সবই বাংলাদেশে বিদ্যমান।
৭.এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ পর্যটন শিল্পকে দারিদ্র বিমোচনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহন করেছে । আমাদের দেশেও এ শিল্পকে দারিদ্র বিমোচনের হাতিয়ার গ্রহন করা যেতে পারে।
৮.পর্যটকদের বিমানবন্দর স্থল বন্দরে ভিসা অন এয়ারভাইলসহ যাবতীয় কার্যক্রম সহজীকরনের জন্য সরকার মন্ত্রনালয়কে নির্দেশ প্রদান করেছে । তা ছাড়াও অনলাইন পর্যটন প্রচারণা হচ্ছে ।মন্ত্রনালয় ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পৃথকভাবে দুটি দৃষ্টি নন্দন ওয়েবসাইট রয়েছে ।
২০১৬ সালের অদ্যাবধি বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলে আমরা পর্যটন শিল্পকে স্বপ্নের অবস্থানে দেখছিনা । কতিপয় সমস্যা আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পকে কাংখিত অবস্থান থেকে দুরে রেখেছে । তবে একথা সত্য যে, আমাদের পর্যটন শিল্পে সমস্যা বিদ্যমান থাকলেও সম্ভাবনা অনেক । সমস্যা সমূহ দূরীভূত হলে আমরা এ সম্ভাবনাময় শিল্পকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব । আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে একধাপ ।বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এ ছাড়াও বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। পর্যটন সক্ষমতা বা প্রতিযোগিতার (টিটিসিআই) দিক থেকে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮। পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে ‘পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি। ’ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব মতে, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ে ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনে ৫০ শতাংশ ও থাইল্যান্ডে ৩০ শতাংশ। মালদ্বীপের অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোও মূলত পর্যটননির্ভর। মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। এশিয়ার সুইজারল্যান্ড নামে খ্যাত ভুটানও পর্যটনে এখন অনেক এগিয়ে।পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন কেন্দ্রের একটি হিসেবে ভাবা হচ্ছে। এ শিল্পের যথাযথ সমৃদ্ধির জন্য যথাযথ সরকারি নীতি প্রণয়ন এবং জাতীয় বাজেটে বাস্তবসম্মত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। পর্যটন শিল্পকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ বেকারত্ব বিমোচন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ এনে দিতে পারে এ শিল্প। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিওটিটিসি) ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৩ সালে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে ১২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যা বাংলাদেশের সর্বমোট কর্মসংস্থানের ১.৮ ভাগ। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ২৭ লাখ ১৪ হাজার ৫০০টি চাকরির সৃষ্টি হয়েছে, যা সর্বমোট কর্মসংস্থানের ৩.৭ ভাগ। ডব্লিওটিটিসির মতে, এ বছরের শেষে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান দাঁড়াবে ৩৮ লাখ ৯১ হাজার, যা বাংলাদেশের সর্বমোট কর্মসংস্থানের ৪.২ ভাগ। এর ফলে বাংলাদেশের এ শিল্পে বার্ষিক কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ২.৯ ভাগ। পর্যটন শিল্পের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ অবদানের ভিত্তিতে ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অবস্থান ১৪২তম। কক্সবাজারের নৈসর্গিক সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ অর্জন করতে পারে বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স,যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বশেষ এই বাংলার সৌন্দর্য, কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায় বলা যায় “ সকল দেশের রাণী সে যে, আমার জন্মভূমি “।